- Published on
বইপড়া, বইশোনা আর আমার পরিবার
- Authors
- Name
- Ibtesum Reza Aninda
- @IbtesumAninda
আমার সাথে কবি রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ছোটবেলায় হলেও, নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয় অনেক পরে, অষ্টম শ্রেণীতে বোধহয়। চিরকুমার সভা
নাটকের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের রসবোধ দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। এই মুগ্ধতার উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে আমি মার কাছে যাই। মা রান্না করত, আর আমি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে লাইনের পর লাইন পড়ে শোনাতাম মাকে। আর দুজনে মিলে হাসতাম একটানা! সে এক মধুর সময় ছিল। পুরো নাটকটাই আমি মাকে রান্নাঘরে পড়ে শুনিয়েছি!
মার সাথে ওই হাসি আড্ডাটা খুব মিস করতাম আমি। তারপর প্রায় আট বছর পরের ঘটনা। পারিবারিক একটা গল্প বলি।
আমাদের বাসায় বিগত প্রায় ছয় বছর ধরে কোন টিভি নেই! শুধু নেই তা না, এটা পুরোপুরি নিষিদ্ধ! সবাই এই নিয়মে পুরোপুরি খুশি আমরা। টিভি নিষিদ্ধ হওয়ার পরে কিছু চমৎকার ঘটনা ঘটে বাসায়। একটা ছোট কাহিনী বলি। আমার ছোট বোন তখন ক্লাস টু তে পড়ে বোধহয়। টিভির অভাবে ডোরেমন দেখা বন্ধ হওয়ায় সে পুরোপুরি বইয়ের নেশায় ঢুকে যায়। দিনরাত বই পড়ত! আস্তে আস্তে ছোটদের বই সব শেষ তার! এখন উপায়? সে যাই পেত তাই পড়ত তখন। একবার ও যখন ক্লাস ফোরে, হঠাৎ দেখি সে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠগল্প সমগ্র পড়ছে! সে কিছুই বুঝছেনা এসব গল্প, তাও পড়ে যাচ্ছে! আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। এই বাচ্চা মেয়েটার প্রতি আমার সম্মান সেদিন অনেকগুণে বেড়ে যায়!
যাই হোক, টিভি নিষিদ্ধ হওয়ার কাহিনীটা বললাম যাতে বুঝতে পারেন যে আমার পরিবারে মিডিয়ার বিনোদনের অভাব আছে।
এখন আসি আসল কথায়। গত বছর লকডাউনের দু তিন মাস পরের ঘটনা। কিচ্ছু করার নেই। মানুষ ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নেয়। আমরা বিশ্রাম নিতে নিতে ক্লান্ত! বাসায় বসে বসে জীবন অতিষ্ট সবার। মা কে আমি প্রায়ই বলি বইটই পড়ো, ভালো সময় কাটবে। কিন্তু মা পড়তে পারেনা দু এক পাতার বেশি। চোখের সমস্যা। কিছুক্ষন পড়ার পরই মাথা ধরে যায়।
এক সময় ভাবলাম, আমরা তো পড়তে পারি! আমরা পড়ব, মা শুনবে! দুইদিন ভাবলাম কি পড়া যায়। হঠাত মনে পড়ল ক্লাস নাইনে নজরুলের পদ্মগোখরা
পড়ে তব্দা খেয়ে বসে ছিলাম আমি। উপন্যাস নয় এটা, গল্প। যেহেতু ছোট তাই মা'র মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হবে। এটাই পড়া শুরু করলাম। আমি একের পর এক লাইন পড়ে যাচ্ছি, মা আর ছোট বোন হা করে শুনছে ! গল্পটা দুর্দান্ত। এক নিঃসন্তান বধুর দুটো গোখরো সাপকে নিজের সন্তানের দৃষ্টিতে দেখার এক অনবদ্য অদ্ভুত কাহিনী! গল্পের সবচেয়ে বড় টুইস্ট শেষ লাইনটায়। শেষ লাইন পড়ার পরে প্রত্যেকের চোখেমুখে কবিগুরুর পঙক্তি ভেসে উঠল,
অন্তরে অতৃপ্তি রবে
সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
সবার মুগ্ধতা দেখে বুঝলাম, এই বই পড়ে শোনানোর আইডিয়া বাজীমাত হয়ে গেছে!
মা'ও খুব খুশি। এরপরে আমরা কোন বই পড়ব, মা নিজেই জানতে চাইল। সেটা নিয়ে আলাপ চলছে। তখন মনে পড়ল ক্লাস টেনে তারাশঙ্করের কবি
উপন্যাস পড়ে কি পরিমাণ মুগ্ধ অথচ বিষন্ন হয়ে বসে ছিলাম আমি! নিতাই, ঠাকুরঝি আর বসন্তের সেই কাহিনী! সেই বিখ্যাত লাইন, "কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে?"
পড়া শুরু করলাম, প্রথম পৃষ্ঠা পড়তে যেয়েই হাসাহাসিতে ঘরটা মুখর হয়ে উঠল। হবেই না বা কেন? নিতাইয়ের পরিচয়টাই তো এমন। “খুনীর দৌহিত্র, ডাকাতের ভাগিনেয়, ঠ্যাঙাড়ের পৌত্র, সিঁদেল চোরের পুত্র” নিতাই হঠাৎ যদি কবি হয়ে যায় তাহলে তার গ্রামবাসীর সাথে আমরা হাসব না কেন! সেই নিতাই একসময় রেললাইনের পাশে, কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ঠাকুরঝির প্রেমে বেধে ফেলে সেই অমর পঙক্তি
কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে?
কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?
এই নিতাই গান বাধতে বাধতে একসময় দেখা পায় ঝুমুর দলের। আর তার সাথে বসন্তের। নিতাইয়ের “বসন”। রুপোপজীবিনী এই রমনী রুপে গুণে মুগ্ধ করে নিতাইকে। সেও মুগ্ধ হয় নিতাইয়ের গুণে।
এই ঘটনাটা আমার মা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। নিতাইয়ের মতো অমন ভালো মানুষ কেন এক পতিতাকে কাছে টেনে নিবে! এ নিয়ে আমার আর মার মধ্যে তুমুল তর্কাতর্কি চলল। মার যুক্তি হচ্ছে , বসন খারাপ মেয়ে। বসন মদ খায়। আমার যুক্তি হচ্ছে, নিতাইয়ের প্রতিভা বসনই শুধুমাত্র বোঝার এবং মানিয়ে চলার ক্ষমতা রাখে। আমাদের দুজনের তর্কের মাঝে ছোটবোন মজা নিয়ে যাচ্ছে। দুজনের বক্তব্যই সে মন দিয়ে শুনে, আর যুক্তির বান দেখে হাসে! হঠাৎ হঠাৎ সেও দু একটা কথা বলে।
একবার নিতাই খিস্তি খেউড়ে পেরে না উঠে ঢক ঢক করে আকণ্ঠ মদ গিলে ফেলে। এটাতে মার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়। নিতাই এমন করল কেন! মদ কেন খেল। এতো ভাল মানুষ মদ খাবে কেন! এটা নিয়েও কিছু তর্কাতর্কি চলল।
এভাবেই ধীরে ধীরে নিতাই, ঠাকুরঝি , বসন, রাজন, রাজনের স্ত্রী সবার সুখ দুঃখ হাসি আনন্দের সাথে আমার পুরো পরিবার একসাথে কেমন যেন মিলেমিশে গেল। বেহালাবাদকের প্রেয়সীর ঘরে যখন খদ্দের আসত, সে করুন সুরে একা একা রাতে বেহালা বাজাত। সেই সুর যেন আমার পুরো পরিবার শুনতে পেত! চোরের ঘরে জন্ম নেয়া নিতাই, সাধারণ লাজুক মেয়ে ঠাকুরঝি, মুখরা রমনী বসন যেন আমাদের পরিবারেই মানুষ হয়ে গেল আস্তে আস্তে। ঝুমুর দলের নেত্রী মাসি যেন ঠিক আমার মা। নিষ্ঠুর কঠোর, শাসনপরায়না দলনেত্রী। মাকে এটা বলে এখনও জ্বালাতন করি আমরা। আমার ছোটবোনকে মা কিছুদিন ঠাকুরঝি বলে ডাকত। আর আমার চুল বড় বড় থাকার দরুন আমাকে অবধারিত ভাবে জ্বালানো হত নিতাই বলে!
সপ্তাহে তিন চারদিন করে বসতাম সবাই বইটা নিয়ে। আমি পড়তাম, সবাই মনযোগ দিয়ে শুনত। ফাঁকে ফাঁকে পড়া থামিয়ে চলত মানবচরিত্র, সমাজ, ভাগ্য, বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা, তর্ক, হাসি আর আড্ডা! একদিন পড়া শেষ হলে পরের দিন কি কি ঘটতে পারে সেটা নিয়েও একটা আলোচনা হতো। হুমায়ুন আহমেদের নাটক নিয়ে যেমনটা হতো। পার্থক্য হলো, এখানে সবটা সবার কল্পনা। একই দৃশ্য সবাই নিজের মতো করে দেখছি। নিজের মতো করে বুঝছি, একেকজনকে একেকটা ঘটনা ছুয়ে যাচ্ছে। উপন্যাস পড়তে পড়তে নিজেদের ঘটনা খুলে বলছি সবাই। নিজের পরিবারকে নতুন করে চিনছি। মতের অমিল কোথায় সেটা জানছি, মতের মিল কোথায় সেটাও জানছি। এতো সুন্দর পারিবারিক আসর আসলে বর্ণনাতীত।
এখন চলছে বিনোদিনী, বিহারি, আশা আর মহেন্দ্রের কাহিনী। চোখের বালি
। এটার আবেদন আরও বেশি। পারিবারিক রাজনীতি, মনের খেলা, ব্যক্তিত্বের সংকটের এই অসাধারণ মনস্তাত্বিক উপন্যাস এখন আমাদের পরিবারটাকে আগলে রেখেছে। নীতি নৈতিকতার লড়াই, নিঃসঙ্গতার বেদনা, কাওকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্খার গল্প এটা। বিনোদিনী, বিহারি, আশা, মহেন্দ্র একে অন্যকে চিনছে ধীরে ধীরে, আমরাও যেন পরিবারের একে অপরকে চিনছি। মায়ের অজানা কাহিনী জানছি, আমার কাহিনী মা,ছোটবোন জানছে, আর ছোটবোন বেশিই ছোট, ওর কাহিনী হওয়ার বয়স হয়নি,ও শিখছে আমাদের কাছে। প্রতিনিয়ত যেন একটু একটু করে আরও বেশি কাছে আসছি সবাই সবার।
কবি উপন্যাসের একটা গানের কলি মা প্রায়ই শুনতে চায়,আমারও বারবার পড়তে ইচ্ছা করে,
এই খেদ মোর মনে মনে
ভালবেসে মিটল না আশ- কুলাল না এ জীবনে।
হায়! জীবন এত ছোট কেনে!
এভুবনে?
জীবনে যা মিটল না কো মিটবে কি হায় তাই মরণে?
এ ভুবনে ডুবল যে চাঁদ সে ভুবনে উঠল কি তা?
হেথায় সাঁঝে ঝরল যে ফুল হোথায় প্রাতে ফুটল কি তা?
এ জীবনে কান্না যত- হয় কি হাসি সে ভুবনে?
হায়! জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?
যে কথা যার মনে ধরে, সে কথাই থাকে অগোচরে! অগোচরে আনাগোনা হলে মন্দ হয়না কিন্তু।
(আরও কিছু পরিবার যাতে এরকম দৃশ্য দেখতে পায়, সেই আশাতেই পরিবারের এই গল্পটা শেয়ার করলাম)